পৃথিবীর অজস্র মানুষকে আমি ঘৃণা করি তাদের মতাদর্শ, জীবনবোধ ও কার্যক্রমের জন্য;
কিন্তু প্রাণকে ঘৃণা করিনা, কেননা তা অদৃশ্য থেকে উৎসারিত এক দৃশ্যমান স্রোত যা দর্শনবোধ দ্বারা চালিত হয় না,
বরং সে সেই অনন্যতা যা সময়ের মরুভূমিতে ক্যাকটাসের মত উঠে আসে শূন্যতার গহীন শেকড় থেকে।
পৃথিবীর এই ঝানু ও উদীয়মান সমস্ত অপরাধের জন্য প্রথমে আমার নিজের দোষ খুঁজে বের করি;
অনেক ভেবে দেখেছি আমার অপরাধ মহাজগতের সমান এবং অপূরণীয় সব ক্ষতির ক্রীড়ানক আমি,
জানি অপরাধী এবং সেই অপরাধে নীরব থাকা মানুষ আসলে ভয়ংকর ভাবে এক, তারা একে অপরের পরিপূরক।
এই লাগামহীন বস্তুপূজার জন্য ভয়ংকরভাবে ঘৃণা করি আমাকে,
মনে আছে এক স্পোর্টস কারের জন্য আমার মা কে বেচে দিয়েছিলাম বাজার নামক কসাইদের হাতে;
স্পোর্টস কার কেনা উপলক্ষ্যে যে রাত্রিভোজের আয়োজন করেছিলাম
ওখানে রংধনু পোশাকের ওয়েটাররা যে আমেরিকান স্টেক পরিবেশন করেছিলো
তা থেকে আমার মায়ের মাংসের ঘ্রাণ আসছিলো।
ওটা কি আসলেই মায়ের মাংস ছিলো, ছেলেবেলায় তার কোলের ভেতর শুয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে
যা তার শরীর থেকে পেতাম, ছোট্ট কামিনী গাছ বসন্তের রাতে মাটির থেকে যে ঘ্রাণ পায় এখনো!
জানি না সমুদ্র আমাকে আর গ্রহণ করবে কিনা, পা ভেজাতে দেবে কিনা তার স্রোতে!
কেননা সামান্য একফোঁটা বিষে বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে মহাসাগর।
আমি কোনোভাবেই আর লুকাতে পারছি না নিজ হাতে তৈরী অন্ধকার
কেননা আকাশের প্রতিটি কোণায় যে জ্বলে উঠেছে নক্ষত্ররা।
সমুদ্র আমাকে পরিত্যাগ করেছে, শুধু আমাকে গ্রহণ করার জন্য সে তো আর
মেরে ফেলতে পারে না তার পেটের ভেতর শান্তিতে ঘুরে বেড়ানো মাছেদের।
আসলেই কি তাদের সেই শান্তি আছে আর!
আমি যে রাষ্ট্রে থাকি তারা তাদের নিজ ছায়া থেকে সৃষ্ট শত্রুর ভয়ে সমুদ্রের তলদেশে পাঠিয়েছে ডুবোজাহাজ;
এমন সতর্ক দৃষ্টিতে তারা ঘুরছে যেন স্বপ্নে নিজেদের দেখা মাত্রই তারা হত্যা করবে তাদের।
নিজেরাই নিজেদের শত্রু হওয়া ছাড়া মানুষের আর কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই এখন।
আমি জানি না মানবসৃষ্ট দাবানলে পুড়ে মরে যাওয়া একটা ছোট্ট ওরাংওটাং শিশুর অভিশাপ থেকে
পৃথিবীর আগমনী মানবশিশুরা নিজেদেরকে আর উদ্ধার করতে পারবে কিনা।
নিজেকে এত ঘৃণা করি যে অন্যরা আমাকে আর ঘৃণা করার সুযোগ পায় না
অথবা বলা যেতে পারে তারাও নিজেকে ঘৃণায় এত ব্যস্ত যে অন্যদেরকে ঘৃণা করার সময় পায় না;
এই জন্য তারা এক সময় আত্মশ্লাঘায় হিরোশিমার পারমানবিক বোমার মত দানবিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে,
যার ফলাফল অনিবার্য মরুভূমি যেখানে এই ক্ষীণ মানবসভ্যতা ফুটে আছে ক্যাকটাসের মত;
তাদের হৃদয় সেই মরুদ্যান যেখানে আগুনের ফুল ফোটে আর ঝরে যায় কান্নার ফোঁটা হয়ে।
জানি না কবে থামবো, কবে থামবে তোমরা যাদেরকে আমি নিজের চেয়ে একটু কম ঘৃণা করি!
জানি না কতদিন আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে এই আত্মহত্যাকারী তিমির কঙ্কাল
যার জারিত হৃদয়শব আমাদের মনকে লবণাক্ত করে দেয় ,করে দেয় উষর!
ওহ! একটা স্পোর্টস কারের জন্য মা কে বেচে দেবার গ্লানি আমাকে কোন দ্রুতগতির আস্বাদ মুছে দিতে পারে!
কত দ্রুত ছুটে গেলে ভুলতে পারি মাটির সেই ঘ্রাণ?
আহ! বস্তপুজা, আমাকে বলি দাও নির্বস্তুক যত প্রেতের উৎসবে, ওরা আমার মাংস গোগ্রাসে খেয়ে যাক
আমার শরীরের উপর নেচে যাক যতসময় না শেষ মানুষটার মৃত্যু হয়।
এবার আমি থামলাম তোমাদের রাণী নামক ডাইনীর প্রাসাদের সামনে
ঘ্রাণ পেলাম মাংসের, পোড়া মাংসের বলি দেয়া শিশুদের মাংসের কাবাবের।
রাজগায়ক হবার লোভে বললাম “আহ কি দারুণ ঘ্রাণ!“
আর ডাইনীকে খুশি করার জন্য গেয়ে উঠলাম এমন সব গান
যে গান আমি নই, যে গান গান নয়, বরং যে গান সেই ড্রাকুলার মত নার্স;
যারা প্রেতশক্তির কবলে পড়ে গভীর রাতের ইনকিউবেটরে শুয়ে থাকা শিশু
আর কোমাতে থাকা বৃদ্ধদের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেয়;
সেই নার্সগুলো নগ্ন হয়ে নাচে আমার গানের তালে,
ওহ আমি সেই অভিশপ্ত গায়ক যার মায়ের উচিৎ ছিলো জন্মের সাথে সাথেই মেরে ফেলা;
কিন্তু মা তো ঘৃণা করে জীবনবোধে তাড়িত মানুষকে, কোনো প্রাণকে নয়;
প্রাণ তো স্বপ্নের মত - যে কারো দেখিয়ে দেয়া পথ ধরে চলে না - চলে তার নিজের দেখানো পথে।
এসব থেকে পালানোর চেস্টাও করেছি অনেক,
অজস্র পর্বতের শিখর আমার ভেতর থেকে উঠে যেত আকাশের দিকে
অজস্র ঈগল তাদের ছায়া ফেলে উড়তো সেই শিখরে
আর আমার নিজেকে মনে হতো সেই সব ঈগল,
কিন্তু এই যে সমতলে পড়ে থাকা দানার লোভ
এই যে ঈগলের সঙ্গীনী হতে চাওয়া ঈগলীনীরা
যারা সব ভূতগ্রস্ত আর বিচিত্র নকল ডানায় সাজিয়ে তোলে তাদের কাম থিকথিকে দেহ
তাদের দুর্নিবার আকর্ষণে উঠে যেতে পারিনি সেই শিখরে।
ঠিক এই জন্য আমার প্রতি ঘৃণা বেড়ে যাচ্ছে প্রবল
আমি জানি এই জন্য একদিন নিজেকে ঝুলিয়ে দেবো মহাকাশের সিলিং থেকে,
এসিড দিয়ে ঝলসে দেবো আমার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা সমস্ত ভ্রুণেদের - যাদের আসার কথা আগামীকাল।
সেইসব সন্ন্যাসীনিরা কোথায়, যারা তাদের জ্যোতির্ময় দেহ থেকে জোনাকীদের ছেড়ে দেয় অন্ধকারে
আর বিষে জর্জরিত পাপাত্মাদের যারা নীহারীকার বলয়ে উজ্জীবিত করে!
কোথায় সেইসব সন্ন্যাসীনিরা? এখন যাদের দেখি এরা আমার মায়ের মত নয়, এরা রাক্ষসী!
আমাদের রক্তপান করার জন্য সন্ন্যাসীনির রুপ ধরে আছে - প্রেম যাদের কাছে সেই কসাইখানার চাবি।
আহ সাপের কূণ্ডলীর মত তীর্থগুলো!
দেহের আড়ালে লুকিয়ে রেখে চিতাবাঘ নিজেকে দেখায় আদুরে বেড়াল
তুমি যখন তার কাছে যাবে বিড়াল থেকে রুপান্তরিত হবে চিতাবাঘে
তোমাকে গ্রাস করবে এক লহমায়, ঢেকুর তুলবে যার দুর্গন্ধ থেকে ঈশ্বরও থাকে বহুদূ্রে।
তোমরা নিশ্চয় সেই সব বিশ্ববিদ্যায়গুলো চেনো যারা তোমাদের শেখায় বস্তুপূজা ও দাসত্ব?
তোমরা নিশ্চয় তার শিক্ষকদের চেনো যারা শয়তানের নিজ হাতের কলের পুতুল?
তোমরা নিশ্চয় চেনো সেই সব আদালাতঘর, শয়তানের নিক্তিতে মাপে যারা দেবদূতদের অপরাধ
আর নিজেদের শয়তানী লুকোতে নিশ্চিত করে তাদের মৃত্যুদণ্ড?
এমন সব স্থানের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার জন্য নিজেকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে রাজী আছি;
কেউ যখন শিলিং থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করে
মনে হয় সে তার নিজেকে হত্যা করার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলে আছে।
মানুষের কাছে মানুষের মহাসময় আসলে কি চায়, কি খুঁজে নিতে চায় যা তার ছিলো না?
না এমন কোনোকিছুই নেই,
সমুদ্র যখন কোনো জাহাজকে ডুবিয়ে নেয় তখন তো আর বলা যায় না
সেই জাহাজের ভেতর থাকা অমূল্য মনিরত্নের লোভে সাগর তা করেছিলো!
বরং সমুদ্র নিজেই জানে কোথা থেকে সে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলো এইসব মনিরত্ন
মুক্তো যা ফলে উঠেছিলো মুখবন্ধ ঝিনুকের বিষের ভেতর।
কোথায় থামবে এই সব জলদস্যুরা! কোথায় থামবো আমরা, থামার আগে ঠিক কতটা ফুঁলে উঠবো!
এই যে অজস্র মনিরত্নে মানুষ ফুঁলেফেঁপে উঠতে চায়
মনে হয় মরার পর একটা লাশও এভাবে ফুঁলে ফেঁপে উঠে অপেক্ষায় থাকে শকুন বা ছোট কীটপতঙ্গের;
তোমরা কি জানো সেই কীটপতঙ্গ বা শকুন তোমরা নিজেরাই!
যারা তোমাকে দ্রুত নিঃশেষ করে পাপ, গ্লানি ও লজ্জা থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে চায়;
আমি জানি আমাদের নিজেদের প্রতি নিজেদের প্রেম সেই কীটপতঙ্গের প্রেমের মত।
পুরোহিত গুলো কোথায় থামবে! কোথায় থামবে এইসব হায়েনার মত রাষ্ট্রনায়কেরা?
কোথায় থামবে এই বিরাট বিরাট নরক কারাখানার মালিকেরা!
কোথায় থামবে আমার এই স্পোর্টস কার? যার জন্য থামিয়ে ছিলাম মায়ের অশরীরী হৃদস্পন্দন!
আমি ভয়ংকর ভাবে ঘৃণা করি আমাকে আর এই কাজটা যখন করছি;
তখন আমার উদ্ধারের আর কোনো পথ নেই
এবং পৃথিবীর অবর্ণনীয় নরকের সড়কে আমার লাশের মত ছুটে যাচ্ছে সেই স্পোর্টস কার,
মায়ের লাশের মত সেই স্পোর্টস কার!
জানি না তাকে থামানোর কি উপায় - যতসময় না চিতাবাঘের মত চাকার নিচে সে সবাইকে পিষে দেয়।
আত্মপ্রেম কি, যা নিশ্চিত করে সবার আত্মঘৃনা বা আত্মগ্লানি?
কসাইখানার সেই পশুর রক্তের মত যা একসময় ঈশ্বরের পবিত্র রক্ত ছিলো
আর এখন তা নর্দমার আবর্জনায় মাছিদের ক্ষুধা মেটানোর খাদ্য!?
মানবপ্রেম কি?
যা তোমাকে তুমি হতে দেয় না আর তুমি অন্যের দেহের মাপে বানিয়ে নাও তোমার জামা?
কাকে তোমরা বলো সাম্য?
অসম ব্যক্তিদের নিজেদের এক আকারে থাকার কোনো যাদুদণ্ড
অথবা চিড়িয়াখানায় সব গণ্ডারের খাঁচা যেমন একরকম?
শোনো আমাকে শোনাচ্ছি তোমরাও শোনো
মানুষের সাম্য কোনোভাবেই আসবে না, যদি না তারা ব্যক্তিগত ভাবে সেই চূড়োয় ওঠার সামর্থ্যবান হয়,
তোমার উচ্চতার তারতম্যের উপর নির্ভর করে না সমুদ্রের গভীরতা
বরং তুমি তোমার খুঁজে আনা গভীরতাবোধ দিয়ে সমুদ্রের সমান গভীর হতে পারো।
আর আমি কে, সে কে, অন্যকেউ কে যে তোমাদের উদ্ধার করবে?
তোমার হয়ে কেউ তো জন্ম নেয়নি!
যদি উড়তে চাও ঈগলদের মত তবে তোমাকেই তোমার আত্মা থেকে
পালক নিয়ে সুনিপুণ কারিগর হয়ে বানিয়ে নিতে হবে ডানা।
অন্যের ডানায় ভর করে নিশ্চয় আকাশের চুড়োয় উড়তে পারবে না
এমনকি নয় ইকারুসের জন্য বানানো তার পিতার ডানাতেও।
সূর্য ঠিকই জানে কার ক্ষমতার কতটুকু সে নিজে ব্যয় করেছে, তুমি তো সূর্যেরই ক্ষমতার ফলাফল;
তাই সে তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে নিচে আর গলিয়ে দেবে তোমার সব নকল ডানা।
ওহ! আমাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করি এই পিতা নির্ভরতার জন্য,
আর আমার পিতার তার পিতার প্রতি আর সেই পিতার তার পিতার প্রতি নির্ভরতায়,
এভাবে সবাই কারো প্রতি নির্ভরশীল এবং শূন্যে ভেসে আছে যে কোনো মুহূর্তে পাতালে পতিত হবার জন্যে।
যেমন আমি পতিত এই বস্তপুঞ্জের ভেতর বস্তুপূজার মন্দিরে
যারা আমাকে গোগ্রাসে গিলে বদহজমে বমি করে দিয়েছে এই স্পোর্টস কারের ভেতরে,
আর আমি ছুটে চলেছি আমার মায়ের শবের মত জীবনের মহাশশ্মানে।
কাদের সাথে আমার এত প্রতিযোগিতা, কার সাথে জিততে চাই, নিজের পরাজিত দানবের সাথে?
কাকে আমি শাসন করতে চাই নিজেকে শাসন করতে পারি না বলে?
নিজেকে নিজে যখন গিলোটিনে চড়াতে চাই বস্তুপুঞ্জরা আর সাড়া দেয় না
তারা জানে আমার প্রাপ্য শাস্তি আরও অনেক বাকী যা মৃত্যুদণ্ড দিলেও অসমাপ্ত থেকে যাবে।
ছুটে চলেছে আমার স্পোর্টস কার সমাপ্তির আশায়
কিন্তু জানি সেই সমাপ্তি আসলে কোনো এক রেসের শুরু আর আমার এই পাপবোধের,
এই বস্তুনির্যাসের হ্যাঙ্গওভার কাটানোর আর কোনো পথে নেই
যেমন কোনো এক পাড় মাতালের আর কোনো উপায় থাকে না পরের দিন আবার মদ খাওয়া ছাড়া।
কাকে বলবো এসো আমাকে উদ্ধার করো!
আমি তো তাকে সরিয়ে জীবনের ঈশ্বর হয়েছিলাম
চেপে বসেছিলাম এই স্পোর্টস কারের সিটে এক রক্তমদির ড্রাইভারের মত,
তোমরা খুব ভালো মতই জানো সিটবেল্ট আমাকে এমন ভাবে বেঁধে ফেলেছে শেকলের মত
শুধুমাত্র গাড়ীর ধ্বংস শেষেই তা থেকে মুক্তি সম্ভব - জানি ধ্বংস অসম্ভব এই স্পোর্টস কারের।
আমি কি এখন শিশুর মত মা কে ডাকতে পারি?
আমি কি এখন মনে করতে পারি মাটির মত সেই মায়ের ঘ্রাণ!
না তা আর সম্ভব নয়! তাকে যে বাজারের মত এক কসাই এর কাছে বেচে দিয়েছিলাম;
কসাইরা সেই মাংস এতসময় কেটে টুকরো টুকরো করে বেচে দিয়েছে তোমাদের কাছে
যা এখন তোমাদের পেটে হজম হচ্ছে নিরালায়
তারপর মেলাবে স্পোর্টস কারের গতিতে গা ছমছমে শূন্যতায়...