বিয়ের ৫৭ বছর সংসার করার পর আজ জানতে পারি চন্দ্রিমা ৩৭ বছর আগেই মা-রা গিয়েছে।

বিয়ের ৫৭ বছর সংসার করার পর আজ জানতে পারি চন্দ্রিমা ৩৭ বছর আগেই মা-রা গিয়েছে।

চন্দ্রিমার সাথে অল্প বয়সেই আমার বিয়ে হয়। আমার একুশ বছর হবে, চন্দ্রিমার সতের বছর। চন্দ্রিমা মধ্যম স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলো। তাই বয়সের ভার খুব একটা বুঝা যেত না ।

ভারতের কোনো শহর থেকে বেশ খানিক দূরে শিব মন্দিরের পাশে পুরোনো লাল ইটের জমিদার বাড়ির চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার বাবার বানানো প্রাসাদ। তিন তলার এই প্রাসাদে একুশটি বাসখানা রয়েছে। পনেরটি ঘরেই চলমান বসবাস। চন্দ্রিমাকে বিয়ে করার পর থেকে আমার জন্যে দুটি ঘর বরাদ্দ। চন্দ্রিমা চুপ চাপ থাকতো, ধর্মের বিষয় গুলোতে খুব মনোযোগী ছিলো। প্রায় অমাবস্যায় চন্দ্রিমাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। পরে খোঁজ নিয়ে দেলহা যেত সে শিব মন্দিরে সারা রাত কাটিয়েছে।

বিয়ের পাঁচ বছর পর আমাদের প্রথম সন্তান হয়। মায়ের দায়িত্ব পালন করতে চন্দ্রিমা সব সময় সেরা থাকতো। একদিন সে তার ছোট ছেলেকে নিয়ে শিব মন্দিরে রাত কাটিয়ে ছিলেন।

সকাল আমার বাবা প্রচণ্ড রেগে চন্দ্রিমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু চন্দ্রিমা দুই দিন যাবৎ মন্দিরেই কাটিয়ে ছিলেন। পরে আবার রাগ ভাঙলে তাকে ফিরিয়ে আনা হয়।

এভাবে বিয়ের ১৫ বছরের মধ্যে আরো দুটি সন্তান সহ চন্দ্রিমা তিন সন্তানের মা হয়। ক্রমান্বয়ে আমরা দুজনেই বৃদ্ধ হতে থাকি। বিয়ের সংসার গড়িয়ে আজ ৫৭ বছর। আমার বয়স আটাত্তর বছর, চন্দ্রিমার চুয়াত্তর বছর। দুজনের চুল সাদা হয়ে গিয়েছে। আর দাড়ি গুলো সাদা হয়েছে। এখনো আমাদের মধ্যে মানসিক মিল। চন্দ্রিমা তার বাবার বাড়ি অর্থাৎ ছোট ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলো। একমাস থেকে এসেছে।মাত্র দু'দিন হলো আমার কাছে এসেছে। চন্দ্রিমাকে ছাড়া এক মাস আমার অনেকটা ঝামেলার মধ্য দিয়েই কেটেছে। মাঝে মাঝে চন্দ্রিমাকে বলি আরো একটা বাচ্চা নেয়া যায় কিনা৷ কারণ আমরা মোট সাতজন সন্তানের বাবা-মা। একসাথে কাটানো ৫৭ বছরের মুহূর্তগুলো দুজনে বসে বসে সন্ধ্যার পর গল্প করতে করতে মনে করছিলাম । আমার চামড়া বটে গিয়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় চন্দ্রিমা এখনো যেন জওয়ান। আমার ঝাপসা চোখে এখনো চন্দ্রিমাকে দেখলে নেশা লেগে যায় । আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, "আমাদের প্রথম রাতের মুহুর্তের সময়ে তোমার সেই মিষ্টি চেহারা যদি এখন আরেকবার দেখতে পেতাম, তাহলে হয়তো অতৃপ্তিতে আমার মৃ-ত্যু হবে না।"

আমি হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরলাম। চলো বিছানায়, শুয়ে থেকে দেখিতো কেমন লাগে। অনেক বছর হলো বৃষ্টির রাতে তোমাকে নিজের কোলে লুকানো হয় না। চন্দ্রিমা হেসে বললো, হাতের লাঠিটাও তো ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারো না শক্তির অভাবে, অথচ আমাকে কোলে নেয়ার শখ জেগেছে। আমি কাপতে কাপতে উঠে দাঁড়ালাম। চন্দ্রিমার হাত ধরলাম, বুড়ো-বুড়ির এমন ঢং কে আর দেখে! কেউই খেয়াল করবে না। তেজ নেই কিন্তু প্রেমের বিলাসিতা মস্তিষ্কে আছে।চন্দ্ৰিমা আমার পাশেই বিছানায় শুয়ে আছে। হঠাৎ কেউ দরজার ওপাশ থেকে জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলো,

-

"বাবা,আমি রবীন্দ্র বলছি,দরজা খুলো।"

আমি বিরক্ত হয়েই দরজা খোলার জন্যে হেটে হেটে গেলাম,

"কি হয়েছে, রাতের বেলা কেউ এভাবে ডাকে?"

-"বাবা আমার সাথে চলো।"

- "কোথায় যাবো,আমাকে কি তোর মতো জওয়ান মনে হয় যে বলার সাথে সাথে দৌড় দিবো। যা বলার এখানেই বল।”

-"এখানে বলার হলে তোমাকে ডাকতাম না, এখনি যেতে হবে চলো।"

রবীন্দ্র আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো, "আমাকে এত রাতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস বাবা।" কিছুটা হাটার পর শিব মন্দিরের দিকে এলাম। অনেক লোককে জড়ো দেখে আমি অবাক হই। কেউ কেউ ধর্মীয় বাক্য উচ্চারণ করছিলেন, কেউ কেউ ভৌতিক ঘটনা বলছিলেন। আমাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে গেলো, এরপর আস্তে আস্তে আমি সামনে এগোলাম। মন্দিরে শিবের মূর্তি পুন:নির্মাণ করার জন্যে মূর্তি সরানো হয়। মূর্তি সরাতেই সবাইকে আশ্চার্য করে দিয়ে বাক্সে এক লা-শ পাওয়া গিয়েছে। আমি লাশটিকে দেখার জন্যেই এসেছি। লাল রঙের কাপড় পড়োনে, পুরো দেহ স্বর্ণালংকারে সাজানো। যেন মনে হচ্ছিলো স্বর্ণের একটি চাদর গায়ের ওপর মোড়ানো। দেখতে-দেখতে আমার চোখ মেয়েটির চেহারার ওপর পড়লো।। আমার শরীরের হাড় গুলো যেন সব একসাথে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। যেন নড়াচড়া করতে পারছি না। এটি চন্দ্রিমার লা-শ। চন্দ্রিমার মধ্যবয়সী সময়ের চেহারার লা-শ। নিজেকে কোনো প্রশ্নই করতে পারছিলাম না। চন্দ্রিমার মতো দেখতে এই লা-শ কারা আমার হাত থেকে কখন যে লাঠি পড়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি। আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

সেদিন চন্দ্রিমার সাইত্রিশ তম জন্মদিন ছিলো, স্পষ্ট মনে আছে, চন্দ্রিমার সেদিনের অপরূপ সাজ- আমি কখনো ভুলবোই না।

সেই রাতে যেই সাজে চন্দ্রিমা সেজেছিলো, আমার জানার কোনো ইচ্ছে ছিলো না।

কিন্তু আজকে মৃত মেয়েটিকে জানার আগ্রহ আর থেমে থাকতে চাইছে না৷

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post