কবে যেন, কোথায় যেন একটা পড়েছিলাম মানুষ নাকি জীবনে মাত্র তিনবার প্রেমে পড়ে। স্রেফ বাজে কথা। এমনটা লেখার আগে আমার সাথে যোগাযোগ করা উচিত ছিল, বিশিষ্ট বন্ধুদের সাথে আলাপ করিয়ে দিতাম যারা কয়েকশো বার প্রেমে আছাড় খায়। তবে সময়ের সাথে বুঝেছি যে কথাটা সিকিভাগ হলেও সত্য। তিনটে প্রেম কি না জানি না তবে ভালোবাসার তিনটে অধ্যায় আছে, বয়সের সাথে তুমি তিনটেই অতিক্রম করবে। নারী বা পুরুষ নির্বিশেষে তিনটে অধ্যায়ই কমবেশি প্রযোজ্য।
প্রথম অধ্যায়ের নাম হলো ‘কুত্তার বাচ্চা ভালোবাসা’, শুনতে খারাপ লাগছে জানি কিন্তু ইংরিজিতে রূপান্তরিত করলেই দেখবে ব্যাপারটা কিউট হয়ে যাবে। ইংরিজিতে এই অধ্যায়টিকে বলে ‘puppy love’। এটা হলো সেই প্রথম প্রেম, যেখানে তাকে রাস্তায় দেখলেই তোমার পেট গুড়গুড় করবে, খাতায় ‘flames’ লিখে কাটাকুটি খেলবে, সাইকেল নিয়ে তার বাড়ির সামনে চক্কর কাটবে, বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করে, তার গলা শুনে লাইন কেটে দেবে, কোন টিউশনে সে যায় সেটা দেখে টুকুস করে সেখানে ভর্তি হয়ে যাবে। এই প্রথম অধ্যায়টিতে তোমার মনে হবে জগতের কেউ তোমার ব্যাথা বোঝে না, সবাই তোমার খারাপই চায়, বিশেষ করে তোমার বাবা মা। আর সেই বিশেষ মানুষটি অবশ্যই বাকি সবার থেকে আলাদা, সে দোষ করলেও সেটা ভুল হিসেবে ক্ষমা করা যাবে। তুমি যদি বুঝেও ফেলো যে পছন্দের মানুষটি অতি নচ্ছার প্রকৃতির, তাও তোমার মনে হবে তুমি নিজে একজন জ্যান্ত সংশোধনাগার। কোনও বন্ধু তোমায় তার বিষয়ে সাবধান করলে, বন্ধুটি তৎক্ষণাৎ তোমার কাছে তার বন্ধুত্ব হারিয়ে ফেলবে।
এর পর অনেক বছর কেটে যাবে, তুমি কি করে যেন এক ধাক্কায় বড় হয়ে যাবে। আশপাশটা তালগোল পাকিয়ে যাবে, পড়াশোনা এবং কেরিয়ারের চাপে তুমি চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে। সেই শত্রু হয়ে যাওয়া বন্ধুটি তোমার জীবনে আবার বন্ধুরূপে ফিরে আসবে, তুমি তার গলা জড়িয়ে কেঁদে ক্ষমা চেয়ে নেবে। তোমার প্রথম প্রেম এখন অন্য কারোর কিন্তু তোমার তেমন কষ্টও হবে না তাতে, কারণ তোমারও পরিধি বেড়েছে, পরিচিতি বেড়েছে, পছন্দও পাল্টেছে। তুমি টিভি থেকে বেরিয়ে নেটফ্লিক্সে ঢুকে গেছো। লাল জামা আর রেড ড্রেসের পার্থক্য বুঝে গেছো। কিন্তু তোমার প্রথম প্রেম তুমি কোনোদিনও ভুলবে না, সেটা যে পবিত্র তা তুমিও জানো আর সেটা যে আর কখনও ফিরবে না, সেটাও তুমিও জানো।
এর পরের অধ্যায়টি হলো ‘মাছ ধরার অধ্যায়’, ইংরিজিতে যাকে বলে ‘fishing phase’। কুয়ো থেকে বেরিয়ে তুমি পুকুরে পড়েছো, পুকুর থেকে নদী, সেখান থেকে সমুদ্দুর। নিজেই হাবুডুবু খাচ্ছো অথচ মাছ ধরার জন্য হাঁকুপাঁকু করছো। না ধরতে পারলে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু বন্ধু মাছভাজা খাচ্ছে দেখলে দ্বিগুণ কষ্ট হচ্ছে। ছিপ ফেলবে না জাল ফেলবে এই নিয়ে নিজের সাথেই রোজ তর্ক করছো। এদিকে মাছেরাও আর চারাপোনা নেই, তারাও রাঘব বোয়াল হয়ে গেছে, কাজেই কার কোন চার পছন্দ তাই নিয়ে তুমি গবেষণা করছো। আগে টিউশন থেকে বেরিয়ে যে কোনোদিন ফুচকা খাওয়া যেত, এদিকে এখন নির্দিষ্ট ডেট, নির্দিষ্ট টাইম মেনে ক্যাফে যেতে হচ্ছে। প্রচুর চিন্তা ঘুরছে মাথায় যেমন ধরো, চুলের স্টাইল কেমন হবে, ড্রেসটা কি পাতি হলো না কি বাড়াবাড়ি করে ফেললে, মাঝেমাঝেই বগল তুলে পারফিউম চেক করছো, টাকাপয়সা নেই বেশি কিন্তু হাবভাব দেখাতে হবে যে যথেষ্ট আছে। যাওয়ার সময় বাসে গেলেও চলবে, তবে ফেরার সময়ে ট্যাক্সির টাকা রাখতে হবে। পড়াশোনার শেষ পর্যায় পৌঁছে গেছো এতদিনে, হয়তো বা চাকরিও শুরু করে ফেলেছো সবে। কিন্তু এইটুকুতে কিছু হচ্ছেই না, টেনশন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একে তো সিনেমা দেখে আর রেস্টুরেন্টে খেয়ে সব পয়সা ফুড়ুৎ হয়ে যাচ্ছে, তার ওপর আবার জিমের চাপে প্রোটিন পাউডার কিনতে হচ্ছে। চারিদিক থেকে ক্রমশ চাপ বেড়েই চলেছে, বাবা মা এখন প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছেন, ইতিমধ্যে হয়তো দেখলে মাছটি চার খেয়ে পালিয়ে গেলো, এদিকে তুমি ফাতনার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বসে আছো।
এর পর তৃতীয় অধ্যায়, অর্থাৎ ‘গলদা চিংড়ি’ অধ্যায়। ইংরিজিতে যাকে বলে ‘lobster phase’, মনে করা হয় একটা লবস্টার তার নির্দিষ্ট সহধর্মিনীর জন্যই জন্মেছে, অবশ্য সেটাও নাকি আদৌ বিজ্ঞানসম্মত নয় । এই অধ্যায়ে তুমি নিজেকে বোঝাবে যে তুমি ম্যাচিওর্ড হয়ে গেছো, এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাবার কোনও মানেই হয় না। এই প্রথম তুমি অনুভব করবে যে সিনেমার টিকিটের থেকে পপকর্নের দাম বেশি। ফ্রেন্ডলিস্টের হাজার জনের ভিড়েও সেই ছেলেবেলার বন্ধুটিই অধিক প্রিয়। কেরিয়ার ছাড়া অন্য কোনোদিকে তুমি মাথাই ঘামাবে না। প্রেম টেম সব আপেক্ষিক বিষয়, বিয়ে হলে হবেখন, তখন দেখা যাবে। এতদিন তোমার নিজের তাড়া ছিল, এবার তুমি দেখবে বাড়ির লোকের তাড়া বেশি। তুমি না চাইলেও তারা তোমার হয়ে ছিপ ফেলে বসবে, ফাতনার দিকে নিজেরাই সিসিটিভি লাগিয়ে রাখবে। এহেন অবস্থায় তুমি রাঘব বোয়াল ছেড়ে ঠিক একটা গলদা চিংড়ি খুঁজে পাবে।
প্রথমে মনে হবে যে এই মানুষটাকে আমি ভালোবাসবো কেন, কি আছেটা কি ওকে ভালোবাসার? ক্রমশ মনে হবে, যেটুকু আছে, ভালো থাকার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। তখন আর চুলের স্টাইল না করলেও চলবে, সর্দি হলে তার জামায় মুছে দেওয়া যাবে, নির্দ্বিধায় পিঠ চুলকে দিতে বলা যাবে, ভুঁড়ি হলেও লুকিয়ে রাখতে হবে না। বোদ্ধার মতন মাথা নেড়ে খটমট ইউরোপিয়ান সিনেমা জোর করে গিলতে হবে না, নিজের ইচ্ছেমতন ঝাড়পিট্টু হিন্দি সিনেমা দেখতে পারো। বা উল্টোটা। পয়সাকড়ির বিষয় নিয়েও সমস্যা নেই, ভালো সময়ে বিরিয়ানি, খারাপ সময়ে ফ্যানাভাত খাওয়া যাবে। ক্যাফে যাওয়ার জায়গায় ব্যালকনিতে ঠ্যাং দুলিয়ে দুজনে চা খাওয়া যাবে। ঘুরতে গেলে তুমি তোয়ালে টুথব্রাশ নিতে ভুলে যাবে না। এমন কি ঘুরতে যাওয়া ক্যানসেল করে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও সমস্যা হবে না। সর্বোপরি তুমি তখন সিনিয়র, প্রথম অধ্যায়ের ছাত্রদের জীবনমুখী শিক্ষা প্রদান করতে পারবে।
তবে হ্যাঁ, যারা ভাগ্যবান, তারা প্রথম প্রেমেই তিনটে অধ্যায় দেখতে পায়।
আর যারা অভাগা, তারা শত প্রেম করেও বা বিয়ের পরেও তৃতীয় অধ্যায়ে পৌঁছতে পারে না।